জকিগঞ্জে কেন্দ্রেীয় মসজিদের তহবিল তসরুপ ও কমিটি নিয়ে উত্তেজনা

আল হাছিব তাপাদার:: জকিগঞ্জ কেন্দ্রেীয় জামে মসজিদের তহবিল তসরুপ ও পরিচালনা কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে ক্ষোভ ও চরম উত্তেজনা দেখা দিয়েছে মুসল্লিদের মাঝে। এ নিয়ে চলছে দফায় দফায় গোপন বৈঠক।

গত ১৫ জুলাই জকিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা হাজী খলিল উদ্দিনের স্বাক্ষরে ডা. আব্দুল হান্নানকে সভাপতি ও আব্দুশ শাকুর চৌধুরীকে সাধারণ সম্পাদক করে ৩ বছর মেয়াদে ১১ সদস্যের কমিটি ও একটি উপদেষ্টা পরিষদ ঘোষনা হয়। এ কমিটিতে বির্তকিতদের স্থান দিয়ে দূর্নীতি আড়ালের পায়তারা করা হচ্ছে বলে মুসল্লিরা অভিযোগ তুলেছেন।

এরআগে মসজিদ পরিচালনায় একটানা প্রায় ২৩ বছর নামমাত্র আরেকটি কমিটি ছিলো। সেই কমিটির সভাপতি সিরাজ উদ্দিন আমেরিকায় যাওয়ার কারণে ও পরে মৃত্যুবরণ করায় সহ সভাপতি মুক্তাদির আহমদকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করে আব্দুল আজিজকে কোষাধ্যক্ষ রেখে সাধারণ সম্পাদক আব্দুশ শাকুর চৌধুরী মসজিদ পরিচালনা করেন। তবে কখনো মসজিদের আয় ব্যয় মুসল্লিদের কাছে প্রকাশ করা হয়নি। এতে তাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠে।

এ নিয়ে সম্প্রতি সময়ে মুসল্লিদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিলে সমাধানের জন্য এগিয়ে আসেন জকিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা হাজী খলিল উদ্দিন। তিনি ৩ বছর মেয়াদী ১১ সদস্যর একটি পরিচালনা কমিটি ও জকিগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান লোকমান উদ্দিন চৌধুরীসহ ১১ জনের সমন্বয়ে একটি উপদেষ্টা পরিষদ ঘোষণা করেন। মেয়র কর্তৃক ঘোষিত এ কমিটি সরকারি গেজেট লঙ্ঘন আখ্যা দিয়ে করে ১০৯ জন মুসল্লি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন দপ্তরে একটি লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছেন।

অভিযোগে তাঁরা উল্লেখ করেন, জকিগঞ্জ কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের ভূমিতে মার্কেট ও দোকান ভিটা থাকায় প্রতি মাসে প্রচুর আয় হলেও মুসল্লিরা কখনো মসজিদের আয়-ব্যয় ও তহবিল সম্পর্কে জানতে পারেননি। মসজিদের সাধারণ সম্পাদক আব্দুশ শাকুর ও কোষাধ্যক্ষ আব্দুল আজিজ ব্যাংক একাউন্ট না করে ২০০০ সাল থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত আয়-ব্যয়ের দায়সারা প্রতিবেদন দাখিল করে তহবিল তসরুপ এবং মসজিদের দোকান কোটা গোপনে বিক্রি করে টাকা আত্মসাৎ করেন। অডিট রিপোর্টে মসজিদের নামে ব্যাংক একাউন্ট খোলার তাগিদসহ বিভিন্ন আপত্তি থাকার পরও তারা ব্যাংক একাউন্ট করেননি।

২০০০ সাল থেকে ২০১১ সালের জুন পর্যন্ত অডিট রিপোর্ট মোতাবেক মসজিদের আয় ৫৪ লক্ষ ৫৭ হাজার ৬১.৫০ টাকা, ব্যয় ৫১ লক্ষ ৩০ হাজার ৩শ ৩৩.৬৬ টাকা। ২০১১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আয় ৯৯ লক্ষ ৭ হাজার ৬শ ৯১.৮৭ পয়সা আর ব্যয় ৮৭ লক্ষ ৫৭ হাজার ৬১০ টাকা। মুসল্লিরা আরও উল্লেখ করেন, মসজিদ কমিটির হিসেব নিকেশ নিয়ে মুসল্লিরা আলোচনা শুরু করলে মসজিদ কমিটির দায়িত্বশীলরা মেয়রকে সামিল করে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে একটি কমিটি গঠন করে অনিয়মকে আড়াল করার চেষ্ঠা করেন। পৌর মেয়রের ঘোষিত কমিটি ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ২০০৬ সালের ৩০ নভেম্বরের প্রকাশিত সরকারি গেজেটের সরাসরি লঙ্ঘন বলেও অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।

এদিকে মসজিদ কমিটি গঠন ও তহবিল তসরুপকে কেন্দ্র করে সাধারণ মুসল্লিদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ ও উত্তেজনা বিরাজ করছে। দফায় দফায় চলছে গোপন বৈঠক। যেকোন সময় অপ্রীতিকর ঘটনা দেখা দিতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। মুসল্লিরা মসজিদের নগদ টাকাসহ সকল সম্পত্তি রক্ষা ও পরিচালনা কমিটি দুর্নীতিবাজ মুক্ত করতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

এ ব্যাপারে জকিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা হাজী খলিল উদ্দিন বলেন, কমিটি গঠন সংক্রান্ত দুটি বৈঠকে মুসল্লিরা আমাকে মুরব্বি হিসেবে কমিটি গঠন করে দিতে দায়িত্ব দেন। পরে ক্বওমী ও ফুলতলী অনুসারীরা দুজন দুজন করে ৪ জন সদস্য আমার সাথে যুক্ত করেন। এদের মধ্যে হাজী সামছ উদ্দিন ও কাজী হিফজুর রহমান দুটি তালিকা দেন। তাদের প্রদত্ত তালিকার নাম থেকে নতুন কমিটি ঘোষণা করি। এ কমিটির মাধ্যমে আগের কমিটির কাছে মসজিদের আয় ব্যয়ের হিসাব চাওয়া হয়েছে। অভিযোগকারীরা অপেক্ষা করতে পারতেন মসজিদ আগের দায়িত্বশীলরা হিসাব নিকাশ দিতে পারেন কি না। মসজিদের তহবিল তসরুপের বিষয়ে তিনি অবগত নন জানিয়ে বলেন, ফুলতলী ছাহেবের অনুসারী একটি পক্ষ মসজিদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। তারা গোপনে ৪টি বৈঠক করেছে। মসজিদ নিয়ে স্বাধীনতা বিরোধীরা অরাজকতা তৈরী করতে চায়। কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে চিহ্নিত কয়েকজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনকে জানিয়ে রেখেছি। স্বাধীনতা বিরোধীরা মসজিদকে সামনে রেখে জকিগঞ্জের আইন শৃঙ্খলার অবনতি করে নিজেরা ফায়দা নিতে চাচ্ছে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে মেয়র বলেন, কেউ আমার কাছে সদ্য ঘোষিত কমিটি নিয়ে অভিযোগ করলে আমি এ কমিটি ভেঙ্গে মসজিদের দায়িত্ব পৌরসভার হাতে নেব।

কমিটি দেয়ার বৈধতা প্রসঙ্গে মেয়র বলেন, কমিটি গঠন নিয়ে যখন উত্তেজনা দেখা দেয় তখন কয়েকজন মুসল্লি আমাকে মুরব্বি হিসেবে কমিটি দিতে অনুরোধ করেন। উত্তেজিত পরিবেশকে শান্ত করতে আমি ফুলতলী ও ক্বওমীপন্থীদের নিয়ে পরিচালনা কমিটি ঘোষণা করি। এ কমিটি নিয়ে অযথা রাজনীতি করার প্রয়োজন নেই।

জকিগঞ্জ পৌরসভা আল ইসলাহর সভাপতি কাজী হিফজুর রহমান বলেন, তহবিল তসরুপের বিষয়ে আলোচনা শুরু হলে তা ধামাচাপা দিতে কমিটি গঠনের তোড়জোড় শুরু হয়। মেয়র সাহেব আগের কমিটির অনিয়মকে ঢেকে রাখতে এককভাবে কমিটি গঠনের অপচেষ্ঠা করলে মুসল্লিরা উত্তেজিত হয়ে উঠেন। পরে মুসল্লিগণ প্রস্তাব করেন মসজিদের কমিটি গঠনের জন্য মেয়র সাহেব আহবায়ক হবেন ও এই কমিটিতে উভয় মসলক থেকে দুজন দুজন করে মোট ৪ জন সদস্য থাকবেন। এ সিদ্ধান্তের পর ক্বওমী মসলক থেকে প্রতিনিধি দেয়া হয় হাজী সামছ উদ্দিন ও মোস্তফা কমান্ডারকে। ফুলতলী মসলক থেকে আমাকে ও নাসিম আহমদকে প্রতিনিধি দেয় হয়। মেয়র সাহেবকে আমরা সরকারের গেজেট অনুসারে কমিটি গঠনের অনুরোধ করলে তিনি তাতে সাড়া না দিয়ে বিক্ষোব্ধ হয়ে ঐদিন সভা ভঙ্গ করেন।

পরবর্তীতে পৌরসভায় একটি সভা করে মেয়র সাহেব আমার কাছে কমিটির জন্য নাম চান। আমি নামের তালিকা জমা দিয়েছিলাম কিন্তু সেই তালিকা মোতাবেক কমিটি গঠন না কওে তিনি আগের কমিটির দুর্নীতিবাজদের নতুন কমিটিতে স্থান দেন। অথচ আগে মসজিদের আয় ব্যয়ের অডিটের সময় মেয়র সাহেব নিজে ঐ লোকদের বিরুদ্ধে অডিট রিপোর্টে গাফলতি ও অনিয়মের অভিযোগ এনেছিলেন। এরপরও তিনি নতুন কমিটিতে রহস্যজনক কারণে তাদেরকেই বেছে নিলেন! মেয়র সাহেব প্রকৃত ঘটনাকে অন্যদিকে মোড় ঘুরিয়ে ক্বওমী-ফুলতলী আলেমদের সম্প্রীতি নষ্ট করতে চাচ্ছেন। ক্বওমী-ফুলতলী নিয়ে কোন দ্বন্ধ নেই।

মেয়র সাহেব ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে দুর্নীতি প্রতিষ্টিত করতে চান। আমারা কোথাও এমনিতে গল্প করতে বসলে তিনি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে খবর পাঠান জঙ্গিরা গোপন বৈঠক করছে। যা অত্যন্ত নিন্দনীয় ঘটনা।

মসজিদের সাধারণ সম্পাদক আব্দুস শাকুর জানান, সাবেক সভাপতি সিরাজ উদ্দিন মৃত্যুবরণ করায় প্রস্তুতি থাকা স্বত্বেও মসজিদের ব্যাংক হিসাব খোলা সম্ভব হয়নি। এখন একাউন্ট করে মসজিদের উদ্বৃত্ত প্রায় ১১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা জমা রাখা হবে।

কোষাধ্যক্ষ আব্দুল আজিজ বলেন, প্রতিহিংসার কারণে এসব অভিযোগ আনা হচ্ছে। আমরা কোন অনিয়ম করিনি। ফুলতলীপন্থী একটি মহল আমাদের সম্মানহানী করতে চায়। অডিট রিপোর্টে মেয়র সাহেব আমাদের কোন গাফলতি পেয়ে থাকলে বলতে পারতেন। তিনি কেন অডিট রিপোর্টে তা লিখলেন জানিনা। মসজিদের নামে ব্যাংক একাউন্ট না করাটা তাদের ঠিক হয়নি উল্লেখ করে বলেন, ব্যাংক একাউন্ট না থাকলেও আয় ব্যয়ের সকল ভাউচার রয়েছে। দোকান কোটা বিক্রি করা হলেও পরে আবার ক্রয় করা হয়েছে।

জকিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিজন কুমার সিংহ জানান, স্থানীয় মুসল্লিদের সাথে আলোচনা করে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে মসজিদ নিয়ে জটিলতা নিরসন হয়ে যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     আরো খবর